শনিবার, ৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বাজারের ব্যাগ বানিয়ে সফল উদ্যোক্তা সাদিনা

১৬০০ টাকায় শুরু, মাসিক আয় এখন ৫০হাজার

গাইবান্ধা প্রতিনিধি
একসময় সবাই তাকে অবহেলা করেছে, অর্থনৈতিক টানাপড়েনে কেটেছে দিনের পর দিন। অর্থের অভাবে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে অনেক সময়। বঞ্চনা-অবহেলা আর অভাবের সাগর পাড়ি দিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের ভবানীপুর ডিলারপাড়া গ্রামের সাদিনা বেগম এখন ওই গ্রামের বঞ্চিত নারীদের মুক্তির অবলম্বন হয়ে উঠেছেন। নিজের কঠোর মনোবল, পরিশ্রম ও একাগ্রতা গাইবান্ধার সাদিনাকে দিয়েছে সফল উদ্যোক্তার সম্মান। কেবল একা ভালো থাকতে চাননি সাদিনা। নিজের অভাবের সংসারে দারিদ্রকে দূরে ঠেলতে মনোবল ও পরিশ্রমের জোরে তিনি গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি হস্তশিল্প কারখানা। যেখানে তার মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত ও বঞ্চিত নারীরা কাজের সুযোগ পেয়েছেন। আর্থিক ও সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে লড়াই করে চলা একসময়ের ভাগ্যবিড়ম্বিত এই নারী এখন নিজের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি গ্রামের ছয় শতাধিক হতদর্দ্রি নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পুরো জেলায়। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র নারীরা সাদিনার কারখানা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানেই এখন কাজ শুরু করে আয়-রোজগার করছেন। নিভৃত গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি বাজারের ব্যাগ জেলার সীমানা ছাড়িয়ে এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় জায়গা করে নিয়েছে। সাদিনা বেগমও পেয়েছেন সফল উদ্যোক্তার পরিচিতি। সাদিনার সফলতার এ পথ মসৃণ ছিল না। ৩৫ বছরের জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে গ্রামের সাধারণ এই নারীকে। ২০০৮ সালে পলাশবাড়ীর ভবানীপুর ডিলারপাড়া গ্রামের মোনারুলের (৪২) সঙ্গে বিয়ে হয় সাদিনা বেগমের। তবে বিয়ের পর থেকে সংসারে অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। একদিন পাশের গ্রামে ব্যাগ তৈরি করতে দেখেন সাদিনা। সে সময়ই এই কাজ করার কথা ভাবেন তিনি। প্রথমে বস্তা কেটে বাজারের ব্যাগ (থলে) তৈরির চেষ্টা করতে থাকেন। এ কাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাগ তৈরির কারিগরি কৌশল রপ্ত করেন। সেই থেকে শুরু তার সংগ্রাম। প্রতিবেশীদের কাছে সেসব পণ্য বিক্রিও করেন, তবে পুঁজির অভাব, বাজারজাতকরণের সমস্যাসহ নানা কারণে সেটা বাণিজ্যিকভাবে হচ্ছিল না। হাঁস বিক্রির ১ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে সাদিনা তার উদ্যোগ শুরু করলেও পরে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কাজের পরিধি বাড়ান। পা-চালিত সেলাই মেশিনসহ ব্যাগ তৈরির উপকরণ কিনে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন কারখানা। পর্যায়ক্রমে ব্যাগের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের আরও কয়েকজন নারীকে কাজ শিখিয়ে তাদেরও ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজে লাগান সাদিনা। তার এ কারখানায় বর্তমানে প্রায় ছয় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেন, যারা গ্রামের সাধারণ দরিদ্র নারী। সাদিনার এ উদ্যোগ গ্রামের দরিদ্র নারীদের জন্য কর্মসংস্থান আর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। সাদিনার কারখানায় কর্মরত ডিলারপাড়া গ্রামের আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, গ্রামে কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় অর্থাভাবে সংসার চলছিল। এ সময় সাদিনার কারখানায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেই উপার্জন করতে পারছি। দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় করছি, যা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ এখন আমিই বহন করি। গ্রামে থেকেই কাজ করে সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করতে পেরে আঞ্জুয়ারার মতো অনেকেই এখন নিজেদের উপার্জনে গরববোধ করেন। সাদিনা বেগম বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাইনি। এখন ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি, ফিরিয়েছি সংসারে সচ্ছলতা। তার কারখানায় গ্রামের নারীদের তৈরি করা ব্যাগ এখন রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় অর্ধলাখ টাকা আয় হচ্ছে এই কারখানা থেকে। তিনি বলেন, শুধু নিজে ভালো থাকতে চাইনি। গ্রামের আর কোনো নারীকে যেন সমাজে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়, সে জন্য কাজের পরিধি আরও বাড়াতে চাই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। সরকারিভাবে সহযোগিতা পেলে আরও বড় পরিসরে কারখানা দিতে পারব। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে পারব।

Share This