পার্বতীপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী মো. মনজুরুল ইসলাম। ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ পায়ের গুলি বের হলেও হাঁটতে পারছেন না মনজুরুল, দিন কাটছে পঙ্গুত্বের শঙ্কায়। বাড়ির বিছানায় শুয়ে-বসে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। অভাবের সংসারে এখন ওষুধ কিনতেই হিমশিম খাচ্ছে তাঁর পরিবার। মনজুরুল ইসলামের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে বাম পায়েই গুলি লেগেছিল যুবক মনজুরুল ইসলামের। তার বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের হুগলি পাড়া মহল্লায়। তার শহরের বাসায় গিয়ে কথা হয় মনজুরুল ইসলামের (৩৪) সাথে। ২০০৯ সালে এইচএসসি পাসের পর আর্থিক অনটনে স্নাতকে (বিএসএস) পাশ করে সংসারের হাল ধরার ইচ্ছা নিয়ে দুই বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। এক ছেলে এক মেয়ে পড়াশোনার খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারের আয়ের সহযোগী হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বাসা ঢাকার রামপুরা টেলিভিশন ভবন এলাকায়। পল্টনের একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে চাকরি করছিলেন মনজুরুল ইসলাম। মেয়ে মিশকাতুল জান্নাত (৯) শহরের এ্যাফেক রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ২য় শ্রেণিতে ও ছেলে ওমর ফারুক ৬ বছর বয়সী পড়ছে স্থানীয় আনোয়ারুল উলুম হিজবুল কুরআন মাদ্রাসা। বাবা আব্দুল জলিল (৮০) দীঘদিন ধরে অসুস্থ মা মরিয়ম বেগম (৬৫) শারীরিকভাবে অসুস্থ। মনজুরুলের বাবা অবসরপ্রাপ্ত আব্দুল জলিল ইউএনও অফিসের নৈশ্যপ্রহরী ছিলেন। মা মোছা. মরিয়ম বেগম গৃহিনী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে মনজুরুল ছোট। গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে মনজুরুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে পরিবারের কাউকে না জানিয়েই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেই। ছাত্রদের ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। সর্বশেষ ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরা টিভি ভবনের উল্টো দিকে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর বাম পায়েই গুলি লেগে বেরিয়ে যায়। একই সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর সামনেই বরিশালের এক তরুণকে মারা যেতে দেখেন মনজুরুল ইসলাম। বলতে বলতে কেদেঁ ফেলেন। এসময় উপস্থিত কয়েকজন তাঁকে পূর্ব রামপুরা বেটারলাইফ হাসপাতালে, রিক্সাযোগে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল ও পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূর্নবাসন প্রতিষ্ঠান নিটোরে নিয়ে যান। খবর পেয়ে ২১ জুলাই সেখানে ছুটে আসেন গ্রামের বাড়ি থেকে স্ত্রী ফজিলা খাতুন (৩২)। পরে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন গত ২৩ আগস্ট। মনজুরুল ইসলামের বাবা আব্দুল জলিল (৮০) বলেন, একমাত্র ছেলে মনজুরুল ইসলাম ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে দুই বছর আগে ঢাকায় যায়। চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে। অল্প বেতনে একটি চাকরিও পেয়ে যায় মনজুরুল ইসলাম। ছেলে যে ছাত্র আন্দোলনে গেছে, যেভাবে বিজিবি ও পুলিশ গুলি করে মানুষ মেরেছে, এর মধ্যেও ছেলে বেঁচে আছে, এতেই তিনি আনন্দিত। আন্দোলনে গিয়ে তাঁর ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তিনি নিজেকে একজন গর্বিত বাবা মনে করছেন। মনজুরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের বন্ধুকের গুলি তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বর্তমানে বাড়িতে এসে স্থানীয় একটি ফার্মেসিতে গিয়ে ড্রেসিং করাচ্ছেন ও ওষুধ খাচ্ছেন। ওষুধ কিনতে তাঁর হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার বাম পায়ের এখন উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু সংসারের অভাবের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। মনজুরুল ইসলামের এর মা মরিয়ম বেগম (৬৫) বলেন, ছইল টার পাওত গুলি লাগছে শুনি মোর যেন মাথাত আসমান ভাংঙ্গি পরোছে। অভাবের সংসার, ওর বাপ আর মুইও ব্যারামোত (অসুস্থ) পড়ি আছু। তার মধ্যে ছইলটা বিছানায় ব্যথাত কাতরাচ্ছে। এ্যালা ওরে ভালো চিকিৎসা করানোর কোনো টাকা-পয়সা হাতে নাই। মনজুরুল ইসলামের স্ত্রী ফজিলা খাতুন বলেন, তাদের দুটি সন্তান। এক মেয়ে মিশকাতুল জান্নাত (৯) ও ৬ বছর বয়সী ছেলে ওমর ফারুক। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তার স্বামী গুলিবৃদ্ধ হওয়ার পর থেকে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আহত স্বামীর চিকিৎসা ব্যয়, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ, বৃদ্ধ শ^শুর-শাশুড়ী অসুস্থ্য ও পরিবারের অন্য খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।