পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীতে অবৈধভাবে বালু লুটের মহোৎসব চলছে। নদীতে পানি কমে শুকনা মৌসুম আসার সাথে সাথেই বালু কারবারিরা সরব হয়ে উঠেছে। বালু উত্তোলন ও বিক্রিতে জমজমাট ব্যবসা চললেও প্রশাসনের তেমন কোন নজরদারি না থাকায় বালু সিন্ডিকেট আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বালু লুটের নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলের মুখ চেনা সেই কারবারীরাই। সরকার পতনের সাথে সাথেই ভোল পাল্টে তাঁরা এখন বিএনপির সাথে মিশে একাকার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাঝে মধ্যে নিয়মিত মামলা, কখনও মেশিন জব্দ, ভ্রাম্যমান আদালত এবং বালু বোঝাই গাড়ি আটক করার পর কিছুদিন বন্ধ ছিল বালু উত্তোলন। আবারও বালু খেকোদের সংঘবদ্ধ চক্র কাজ শুরু করেছে।
সরেজমিনে উপজেলার করতোয়া নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। করতোয়া নদীর পাড় ঘেষে পৃথক ১৩টি স্থানে ড্রেজার ও স্যালো মেশিন বসিয়ে পাইপ দিয়ে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে বালু। ইটের গাথুনির কাজে মোটা বালু এবং মাটি যুক্ত (ভিট) বালু ভরাট কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে করে গ্রামীণ জনপদের খানাখন্দের সৃষ্টিসহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ পাকা সড়কগুলো। উপজেলার ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া সেতুর উত্তর পাশে আওয়ামী লীগ নেতা সাজেদুল ইসলাম এবং তাঁর পাশেই কাচদহ ঘাটে মুক্তার মিয়া মেশিন দিয়ে বালু টানছেন। মাহিন্দ্র যোগে দিনরাত রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রশাসনের চাপ রয়েছে বালুর পয়েন্টর উপর, তারপরেও অন্যভাবে চলছে তাদের ব্যবসা। সেতুর দক্ষিণ পাশে বোয়ালমারী গ্রামে করতোয়া নদীতে ওই গ্রামের মমদেলের ছেলে আমিনুল ও আনোয়ার মিয়া, আবু বক্করের ছেলে মোক্তার, আব্দুস সোবহানের ছেলে কিনা মিয়া ৩টি স্যালো মেশিন দিয়ে পাশাপাশি
পৃথক ৩টি স্পটে বালু উত্তোলন করছে। আক্ষেপ জানিয়ে ওই গ্রামের তাহেরুল জানান, প্রায় ১ যুগ ধরে এই স্থানে বালু উত্তোলন হলেও বন্ধ হয় না। এটা বন্ধ করার ক্ষমতা কারও আছে কিনা জানিনা।
ওয়াকিল মিয়া জানান, নদী থেকে স্যালো মেশিন ও পাইপের সাহায্যে উঠানো বালু উপরিভাগে আমাদের কয়েকজনের জমিতে স্তুপ করে রাখা হয়। বিনিময়ে প্রতিমাসে ৫০০/৭০০ টাকা করে পাওয়া যায়। স্যালো দিয়ে বালুর ব্যবসা করে আসছেন টানা কয়েক বছর ধরে। না প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজনের সাথে বলে জানা যায়, মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকজন এসে এসব বালু পয়েন্টে গিয়ে পাইপ কেটে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এতে তাদের ক্ষতি হলেও পরবর্তীতে তা পুষিয়ে নিতে হয়। সম্প্রতি থানায় মামলা হয়েছে, নানা কারণে ঝুঁকি নিয়ে তবুও এই ব্যবসা করছি। এখানে মোটা বালু নেই। ৩টি পয়েন্টেই মাটি যুক্ত (ভিট) বালু উত্তোলন করা হয়। মোটা বালু তাদের এলাকায় নেই। যে কারণে তারা এই ব্যবসায় খুব একটা লাভবান হতে পারছে না।
এদিকে খালাশপীর হাট থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে বড় আলমপুর ইউনিয়নের বাঁশপুকুরিয়ায় বড় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন ওই গ্রামের ৫০/৬০ জন। পয়েন্টের লোকজন বলছেন, এখান থেকে দিনাজপুর এলাকার ২ কিলোমিটার দূরে পাইপ দিয়ে বালু টানা হচ্ছে। তাদের পয়েন্টে মোটা বালুর চাহিদা প্রচুর, সেই কারণে একটি ভেকু মেশিন দিনরাত গাড়ি ভর্তি করার কাজে ব্যস্ত থাকে। এখান থেকে প্রতিদিন শতাধিক গাড়ি বালু উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটি এই এলাকার সবচাইতে বালুর বড় পয়েন্ট। একই ইউনিয়নের পত্নীচড়া বাজার থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে রামনাথপুরে করতোয়া নদীর বানুর ঘাট নামক স্থানেও স্যালো মেশিন দিয়ে বিপ্লবের নেতৃত্বে গ্রামের অর্ধ-শতাধিক যুবক এ ব্যবসার সাথে জড়িত।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, গ্রামের রাস্তা অচল করে বালুর ব্যবসা করা হয়। সেই কারনে পয়েন্ট বন্ধের জন্য এলাকার সাধারন মানুষ নানাভাবে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এখন ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। সাংবাদিকদের সামনে কথা বললেও কেউ নাম প্রকাশ করার সাহস পাননি। গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী বালুর ওই পয়েন্ট থেকে গাড়ি প্রতি টাকা পান বলেও জানা গেছে। বালুর পয়েন্টে কখনো প্রশাসনের লোকজন বা সাংবাদিক ঢুকলে মেশিন চালক/শ্রমিককে নিয়োগকৃত লোকজন আগে থেকেই সংকেত দেয়। ফলে তারা মেশিন বন্ধ করে সটকে পড়ে। কাঞ্চন বাজার থেকে পশ্চিমে হোসেনপুরের পাশের করতোয়া নদীর কুলানন্দপুর ঘাট। সেখানে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার কুলানন্দপুর গ্রামের শামীমসহ পীরগঞ্জের হোসেনপুর গ্রামের প্রায় ১৪/১৫ জন যুবক সংঘবদ্ধভাবে বালু তুলছে। তাদের লোকজন জানান, প্রতিগাড়ি বালু ৭’শ টাকায় বিক্রি হয়। চতরা ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিমে ৫ কিলোমিটার দূরে কুয়াতপুর হামিদপুর বিহারি পাড়া। করতোয়া নদী শাসনের জন্য সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্লকের কাজ করেছেন অথচ ব্লকের পাশে থেকেই দেদারছে বালু উত্তোলন করছেন বর্তমান ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেকা নুর মোহাম্মদ গোল্লার নেতৃত্বে ১৫/২০ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, বিহারি পাড়া পীরগঞ্জ থানা এলাকা হলেও নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রশাসনের লোকজন কম আসে। কারণ ১০ কিলোমিটার পথ ঘুরে এখানে আসতে হয়। চতরা ইউপি সদস্য নূর মোহাম্মদ গোল্লা এই পয়েন্টে রমরমা ব্যবসা চলে সারা বছর। তিনি এই পয়েন্টের বালু দিনাজপুর এলাকায় বিক্রি করে থাকেন। অপরদিকে চতরা ইউনিয়নের সোনাভরি বিলের পাশে আশ্রয়ণ কেন্দ্র ঘেঁষে মালিকানা জমি থেকে বালু উত্তোলন করছেন বকুল মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তার বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর এবং সরকারি বিলের পাড়। এলাকাবাসীর অভিযোগ বালুর গাড়ি এলাকার কাঁচাপাকা রাস্তাঘাট নষ্ট করে দাপটের সাথে যাতায়াত করে। এইসব গাড়ির দাপটে গ্রামের পুরুষ-মহিলা এবং স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে সবসময় আতংকের মধ্যে থাকে। ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেকা নুর মোহাম্মদ গোল্লার সাথে কথা হলে তিনি জানান, বালু না হলে পাকা দালান, বিল্ডিং হবে কিভাবে? আপনারা (সাংবাদিক) আপনাদের কাজ করেন, আমি আমার কাজ করি। চতরা ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক শাহীন জানান, নুর মোহাম্মদ গোল্লা আমার পরিষদের মেম্বার। তিনি বালুর ব্যবসা করেন, আমার জানা নেই। তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা বেগম জানান, ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে শ্যালো মেশিন যব্দ করে পাইপ ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা আরো কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।