কামরুল হাসান জুয়েল, পীরগঞ্জ (রংপুর)
রংপুরের পীরগঞ্জে চলতি মৌসুমে পানিফলের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলোতে বছরে একবার মাত্র ধানের চাষ হতো। বছরের বাকি সময়ে ওই জমিগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকতো। রোপা আমন ধান জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকতো। জলাবদ্ধতার ওইসব জমিতে এখন বিকল্প হিসেবে পানি ফলের চাষ করা হচ্ছে। পানিফলের চাষ করে এখন অনেক কৃষকেরই ভাগ্য বদলে গেছে। এলাকায় নতুন করে অনেক কৃষকই পানি ফল চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।
আষাঢ় মাসের বৃষ্টিতে জলাশয়গুলো ভরে উঠলে ওই পানিতে পানিফলের চারা ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্রমেই চারা গাছ বেড়ে সবুজের চাদরে ঢেকে যায় জলাশয়গুলো। ভাদ্রমাস থেকে গাছে ফল আসা শুরু করে এবং কার্তিক মাসের শেষে ফল বিক্রি শুরু হয়। নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমি লীজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে পানি ফলের চাষ করছেন অনেক কৃষক। এজন্য প্রতি বছর এই ফল চাষের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। পীরগঞ্জ উপজেলার মিঠিপুর ইউনিয়নের একবার পুর গ্রামের বাদশা মিয়া পানিফল চাষ করে এখন স্বাবলম্বী। কয়েক বছর পূর্বেও জীবিকার তাগিদে ঢাকা শহরে রিক্সা চালাতো। পরিবার ছেড়ে ঢাকায় মন বসাতে না পেরে কিছু টাকা জমিয়ে মাটির টানে বাড়িতে ফেরে সে। গ্রামে ফিরে বাড়ির পার্শ্বের পরিত্যক্ত একটি জলাশয় লীজ নিয়ে প্রথমে সে মাছ চাষের চেষ্টা করে। মাছ চাষ করতে যত টাকার প্রয়োজন, সে টাকা জোগাড়ের জন্য বিভিন্ন জনের নিকট ধর্ণা দিয়েও তা জোগাড় করতে না পেরে এক সময় সে হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এতেও সে না দমে নতুনভাবে চিন্তা করে। ওই জলাশয়টিতেই পানি ফলের চাষ শুরু করেন। এতে সফলও হয় সে। প্রথম বছর খরচ বাদে তার ১০ হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর সে আরো একটি জলাশয় লীজ নিয়ে তাতেও পানিফলের চাষ শুরু করেন। ক্রমেই সে ওই এলাকার কয়েকটি পরিত্যক্ত জলাশয়ে পানিফলের চাষ করে সংসারের অভাব মিটিয়ে সাবলম্বী হয়ে ওঠেন। বর্তমানে সে ৭ একর জমি লীজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে পানিফলের চাষ করেছেন। ৭ একর জমিতে চাষাবাদ বাবদ তার মোট ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৯ হাজার টাকা। ঔষধ ও পরিচর্যা ব্যয় মিটিয়ে এর থেকে তার নীট আয় হবে দুই লক্ষাধিক টাকা।
বাদশা মিয়া জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকার এসে তার জমি থেকে পানিফল ক্রয় করে নিয়ে যায়। আরো কথা হয় উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের সয়েকপুর গ্রামের পানি ফল চাষি পরিমলের সাথে। তিনি ৩৩ শতক বিলের পানিতে পানিফল চাষ করে এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। পানি যতদিন থাকবে ততদিন ফলও পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি। জমিতে আরও যে পরিমাণ ফল রয়েছে তা বিক্রি হবে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। একই এলাকার বামনীর বিলে ৭০ শতক জমিতে পানি ফলের চাষ করে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন জাহাঙ্গীরাবাদ গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মিজানুর রহমান। তার সাথে তার স্ত্রীও এই পানি ফল
চাষে কাজ করছেন। মিজানুর রহমান জানান, জমিগুলো পানির নিচে ডুবে থাকে। প্রথমবার পানিফল চাষ করে ভালো টাকা পেয়েছেন। আরও অনেক ফল পাবেন তিনি। একই ইউনিয়নের পানেয়া গ্রামের তারা মিয়া বলেন, উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নে অনেক বিল, ঝিল আছে। আমাদের এলাকার লোকজনের মধ্যে এই আবাদ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। পানেয়া গ্রামে আমিই প্রথম এই চাষ শুরু করেছি। বর্তমানে এ এলাকায় ২৫/৩০ জন পানি ফলের চাষ করছে। স্থানীয় ভাবে এই ফলকে বলা হয় সিঙ্গর। ফল নিয়ে কোন ভোগান্তি নেই। কারণ জলাশয় থেকেই ফল বিক্রি হয়ে যায়। কাচা ফল ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। হাট বাজারে সিদ্ধ করে সেই ফল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। পীরগঞ্জ বাজারের খুচরা বিক্রেতা অনুকুল সাহা জানান, সিদ্ধ পানিফলের খুব চাহিদা, বিক্রিতে কোনই সমস্যা নাই। আমি প্রতিদিন কমপক্ষে এক মণ বিক্রি করি। এই ফল আগে অন্য জেলা থেকে এনে বিক্রি করেছি। ২/৩ বছর থেকে এলাকাতেই পাওয়া যাচ্ছে। পাঁচগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া জানান, আমার ইউনিয়নে অনেক বিল রয়েছে। ইতোপুর্বে বছরে একবার ধান চাষের পর পড়েই থাকতো। বর্তমানে ওই জমি গুলোতে ব্যাপক হারে পানি ফল চাষ করা হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাদেকুজ্জামান সরকার জানান, অনাবাদি জমিতে পানি ফলের চাষ করা যায়। এই আবাদে খরচ কম। সময়মতো ফলের গাছে বালাইনাশক প্রয়োগ করলেই ফলন ভালো পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত নিচু জমিতে পানি ফল চাষ করে অনেকেই লাভবান হয়েছে।