রবিবার, ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ফুলবাড়ীতে ঐতিহ্যবাহী চড়ক মেলায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়

চড়ক মেলার প্রধান আকর্ষণ চড়কে ঝুলছে যুবক।

নিজস্ব প্রতিবেদক
হাজার হাজার মানুষের দৃষ্টি ৩০ ফুট উচ্চতার কাঠের দণ্ডের দিকে। একজন মানুষ পিঠের চামড়ায় গাঁথা লোহার বড় দুটি বড়শি গেঁথে দণ্ডটির চারপাশে শুণ্যে ঘুরছেন। চলছে উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি। বাজছে ঢাকঢোল। ঘুড়ানো হচ্ছে কাঠের দণ্ডটি। আর তাতেই ঝুলে চারিদিকে গোল চক্কর খাচ্ছেন অরবিন্দ চন্দ্র রায় (৪২) নামের এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে থাকা ফুল-জল, আবির, কলা, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দেন অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজার দৃশ্য এটি।

আজ শনিবার গোধূলী লগ্নে পৌর এলাকার চাঁদপাড়া কালী মন্দির সংলগ্ন শ্মশান মাঠে পূজাকে কেন্দ্র করে পিঠ ফোঁড়া বা চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। চড়ক উৎসব ও মেলা দেখতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কয়েক হাজার বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ সমবেত হন।

আয়োজক সূত্রে জানা যায়, বড়শিতে বিদ্ধ মানুষকে ঘোরানোর আগে সারা দিন ধরে নানা আঁচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। মানুষ ঘূর্ণনের জন্য স্থাপিত কাঠের দণ্ডটি মাঠের মাঝখানে বসানো। দণ্ডের উপর অনেকটা লাঙলের জোয়ালের মতো আরেকটি কাঠ লম্বালম্বিভাবে বসানো। কাঠের একপ্রান্তে মাটি পর্যন্ত ঝোলানো থাকে কয়েকটি লম্বা দড়ি। কাঠের দণ্ডের ঠিক নিচে একদল মানুষ শক্ত হাতে দড়িগুলো দণ্ডটির চারপাশে ঘোরান। এটাই চড়ক পূজার মূল আকর্ষণ।

মেলাকে ঘিরে ফুলবাড়ী ও আশেপাশের এলাকায় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে সমবেত হয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির স্বাদ নেন। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা, আর শিশু-কিশোরদের জন্য থাকে নাগরদোলা ও বিভিন্ন মিষ্টান্নের আয়োজন।

মেলায় আগত দর্শনার্থীদের একাংশ

স্থানীয় এক দর্শক বলেন, “প্রতি বছরের মতো এবারও চড়ক মেলা দেখতে এসেছি। আমাদের সনাতন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এমন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ।”

চড়ক পূজার উৎসবে আসা শাপলা রানী ও রিত্তিকা মহন্ত বলেন, এই চড়ক মেলা উপলক্ষে আমাদের পুরো গ্রাম উৎসবে মেতে ওঠে। সবাই মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয় স্বজনদের আমন্ত্রণ জানায়। তারা আসেন। মেলাসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
গাইবান্ধা থেকে আসা মাহাবুব নামের এক ব্যক্তি জানান, এখানে আত্মীয়ের বাড়ি এসেছিলাম। শুনলাম পিঠ ফোঁড়া চড়ক মেলা হবে। আমাদের ওইদিকে এসব হয়না তাই থেকে গেলাম মেলা দেখার জন্য। তিনি আরও বলেন, সত্যি এ এক অবাক করা ব্যাপার, কারণ কীভাবে একজন মানুষের পিঠে ওই বড় বড় বড়শি বিঁধে দিয়ে ৩০/৩৫ ফিট উচ্চতায় ঝুলিয়ে ঘোরানো হচ্ছে।
উৎসব আয়োজক কমিটি চাঁদপাড়া মন্দির কমিটির সভাপতি সুরজিত কুমার দাস বলেন, চৈত্র মাসের শেষে চড়ক কালী পূজা বা নীল পূজার আয়োজন করা হয়। এই পূজা ও চড়ক উৎসবকে কেন্দ্র করে দিনব্যাপী মেলা বসেছে। এতে কয়েকে হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
বড়শিতে ঝুলে থাকা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর এলাকার উত্তর কৃষ্ণপুর গ্রামের মতিলালের ছেলে অরবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, দীর্ঘ এক যুগেরও অধিক সময় থেকে দেশের বিভিন্নস্থানে এই কাজ করছেন তিনি। তাঁর পিঠে অগণিত ছিদ্র রয়েছে। প্রত্যেকবার পিঠের ভিন্ন ভিন্নস্থানে ছিদ্র করে বড়শির কল লাগানো হয়। এটি করতে বেশ সাধনার প্রয়োজন।

Share This