ফুলবাড়ীতে চুরি ঠেকাতে রাত জেগে গ্রামবাসীর পাহারা, আটক ৮

নিজস্ব প্রতিবেদক
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আশঙ্কাজনকহারে চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসী। থানায় বারবার অভিযোগ দিয়েও চুরি বন্ধ না হওয়ায় নিজেরাই রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন তারা।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাতে চোর চক্রের ৮সদস্যকে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের উপযুক্ত শাস্তি ও হারানো মালামাল ফিরে পেতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী থানায় জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে ওসির আশ্বাসে গ্রামবাসীরা ফিরে যান।
আটককৃতরা হলেন, উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের রাজারামপুর গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে তরিকুল ইসলাম (৩০) ও শরিফুল ইসলাম (২২), রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোরাগাস্ত মিয়াপাড়ার মৃত সাদেক আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৩৬), ফুলবাড়ী উপজেলার রাজারামপুর মৎস্যপাড়ার আব্দুর রউফের ছেলে সামিউল ইসলাম (২৯), রাজারামপুর দক্ষিণ পাড়ার দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী ছবির বেগম (৪০), শুকুর শেখের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৪৫), নাসিম আলীর স্ত্রী সালমা খাতুন সুম্মা (৩০), আফাজ উদ্দিনের ছেলে নাসিম আলী (৩৫) ও রাজারামপুর ডাঙ্গাপাড়ার আব্দুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমান (৩২)।
জানা যায়, গত একমাসে উপজেলার পৌর এলাকার কাঁটাবাড়ী, মধ্যগৌরীপাড়াসহ শিবনগর ইউনিয়নের রাজারামপুর, ডাঙাপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ বিভিন্ন দোকান ও বাড়িতে অভিনব কায়দায় অন্তত ৫০ টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। রক্ষা পায়নি সরকারী দপ্তরও। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়েও রাতের আধারে তালা কেটে চুরির ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকায় কয়েক বার এমনকি একই বাড়িতে পরপর তিনবার চুরির খবর পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা প্রতিবার থানায় লিখিত অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার না পেয়ে তাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই ফুলবাড়ী পৌর এলাকার পশ্চিম কাঁটাবাড়ী এলাকার মিন্টু সরকারের ঘরের জানালা ভেঙ্গে প্রায় ৫ ভরি স্বর্ণসহ নগদ ১ লক্ষ টাকা চুরি হয়। ১ আগস্ট ফুলবাড়ী পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের মধ্যগৌরীপাড়া গ্রামের রায়হান চৌধুরীর বাড়িতে গভীর রাতে ঘরের জানালা ভেঙ্গে ৩ ভরি স্বর্ণ, ৭ ভরি রুপাসহ মোবাইল, আসবাবপত্রসহ ৫০ হাজার টাকা চুরি হয়। সপ্তাহ না কাটতেই একই এলাকার হাফিজুল ইসলামের বাড়ি থেকে আসবাবপত্রসহ টাকা চুরি হয়। গত ৬ আগষ্ট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়ের জানালার গ্রিল কেটে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরায় দেখা গেলেও চোরকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা ৭নং শিবনগর ইউনিয়নের রাজারামপুর এলাকার অবস্থা আরও খারাপ। গত রোববার (১০আগস্ট) রাজারামপুর দক্ষিণপাড়ার মোরসালিন হাজির বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি সংঘটিত হয়। ক্যামিকেল স্প্রে করে গ্রিল কেটে ৫ ভরি স্বর্ণ, সাড়ে ৮লাখ টাকা, ৪ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল চুরি করে নিয়ে যায়। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার বাড়ী থেকে দুই জোড়া স্বর্ণের বালা, কানের ঝুমকা, চেইন ও মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী রুবেল মিয়ার গোয়াল থেকে ২টি বিদেশী গাভি চুরি হয় যার দাম ৬ লাখ টাকা। ভিমলপুর গ্রামের কোরবান আলী আজাদের বাসা থেকে ২৭ জুলাই রাতে একটি ডিসকভার ১৩৫ সিসি গাড়ি চুরি হয়। একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের একটি দোকানে পরপর তিনবার চুরি হয়ে মোট প্রায় ২৫লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে গবাদি পশু, আসবাবপত্র, অটোচার্জার, অটোভ্যান, রিকশা চুরি হচ্ছে।
ভুক্তভোগী শাহানা পারভীন, রোকনুজ্জামান রনি, মাজেদুর রহমান, মোরসালিন ইসলাম জানান, প্রতিটি চুরির ধরন প্রায় একই রকম। চোরেরা ঘুমের ওষুধ জাতীয় কিছু স্প্রে করে সবকিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। একই গ্রামে বারবার চুরির ঘটনায় প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও চুরি বন্ধ হয়নি, পুলিশ তেমন কোন জোরদার ব্যবস্থাও নিচ্ছেনা।
রাজারামপুর ডাঙাপাড়া বাজার কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এক সপ্তাহে ৫টি চুরিসহ সম্প্রতি ১০-১২ চুরি সংগঠিত হয়েছে এই এলাকায়। প্রতিটি চুরির ঘটনার পর থানায় অভিযোগ দিলেও কোন প্রতিকার না পেয়ে আমরা নিজেরা রাত জেগে পাহারা বসিয়েছি। গত সোমবার রাত ২টায় দিকে চুরি করতে আসা কয়েকজনকে আটক করা হয়। পরে একই গ্রামের চিহ্নিত চোর দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে মোরসালিন হাজির চুরি যাওয়া টাকার মধ্যে ১লাখ ৩০হাজার টাকা, কিছু স্বর্ণ ও কিছু সৌদি রিয়াল উদ্ধার করে পুলিশ।
শিবনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামেদুল ইসলাম বলেন, একই এলাকায় বারবার চুরির বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। এটি একটি বড় চোরচক্র। তাদের চুরি ধরন অনেক আধুনিক। এলাকাবাসী বাধ্য হয়ে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে। তারা সন্দেহভাজন কয়েকজনকে দেখে পুলিশকে জানায়। পরে তাদের সহযোগিতায় পুলিশ ৮জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। আইন হাতে তুলে না নিয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম খন্দকার মুহিব্বুল বলেন, ওই গ্রামে চুরি হতে পারে এমন তথ্য আগেই পুলিশের কাছে ছিলো। গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশ ওই গ্রামে অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে আসে। পরে গ্রামবাসীরা ১জনকে আটক করলে পুলিশ গিয়ে রাত ২টার দিকে বাঁকিদের আটক করে। একই সাথে আসামী দেলোয়ারের বাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে মোরসালিন হাজির চুরি যাওয়া ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও কিছু স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। আজ দুপুরে মোরসালিন হাজি তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন, যার মামলা নং ০৬।
তিনি বলেন, পুলিশ চুরি বন্ধে জোরালো ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩০-৪০জন চোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা আদালত থেকে জামিনে এসে আবারও চুরি করছে।
তিনি আরও জানান, এই চোরেরা মূলত মাদক সেবি। মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে চুরি করে তারা। পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। সবাই সহযোগিতা করলে মাদকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। সকলের সচেতনতায় পারে মাদক ও চুরি রোধ করতে।