লিচুর জেলায় মরুর খেজুর চাষ
বছরে অর্ধকোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রির আশা

নিজস্ব প্রতিবেদক
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা শহরের ঢাকা মোড় থেকে রংপুর যাবার সড়কের বামদিকে চোখে পড়বে হাস্কিং মিলের চাটাল,গুদাম ঘর সংলগ্ন ইটের প্রাচীর ঘেরা একটা জায়গা। প্রাচীরের উচ্চতা ভেদ করে মাথা দোলাচ্ছে খেজুর গাছের সবুজ পাতা। প্রাচীরের অভ্যন্তরে লাগানো রয়েছে ১৯টি খেজুরগাছ। অধিকাংশ গাছে থোকায় থোকায় খেজুরের কাঁদি ঝুলছে। হলুদ রঙের কাঁদির সাথে ঝুলছে সবুজ রঙের খেজুর। ইতিমধ্যে কাঁদিগুলোকে গাছের ডালের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। এই বাগান গড়ে সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন জাকির হোসেন (৪৭) নামে কুয়েত ফেরত এক প্রবাসী ।
জাকির হোসেন, ফুলবাড়ী পৌর শহরের স্বজনপুকুর এলাকার আবু আব্বাসের ছেলে। ১৯৯৯ সালে এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে কুয়েত প্রবাসী হন। শুরুতেই কুয়েতের ‘সুয়েব’ শহরে মোটর গ্যারেজে চাকুরী নেন। এরপর ধীরেধীরে কর্মচারী থেকে গ্যারেজের মালিক হন। সুয়েব শহরে প্রতিটি বাড়িতে, রাস্তায় প্রায় সবখানে খেজুরগাছ দেখে উদ্বুদ্ধ হন জাকির। সেটা দেখে নিজের দেশে খেজুরবাগান করার পরিকল্পনা করেন। চাষের পদ্ধতি শিখেন অলাইনসহ খেজুর চাষীদের কাছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে থাকেন জাকির। ২০১৭ সালে ফুলবাড়ী পৌর শহরের স্বজনপুকুর এলাকায় নিজের ২০ শতক জমিতে বোপন করেন খেজুরের বীজ। তারপর বীজ থেকে চারা, চারা থেকে পরিপুর্ণ গাছ এবং ২০২২ সালে প্রথমবারের মত রোপনকৃত গাছে দেখা মেলে কাঙ্খিত সেই খেজুর ফলের। তার এই সফলতা এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে গিয়েছেন। অর্থনৈতিক মুক্তিসহ প্রায় সব ধরণের প্রশান্তি যেন খেজুরগাছের ছাঁয়ায় খুঁজে নিয়েছেন জাকির হোসেন। তাই আর প্রবাসে ফেরেননি তিনি।
খেজুর বাগানে দেখা মিলে জাকিরের। কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে ফলন্ত খেজুর গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এসময় কথা হলে তিনি জানান, প্রায় দুই একর জমিতে খেজুরগাছের বাগান ও চারা উৎপাদন করছেন তিনি। নার্সারীতে বিক্রির উপযোগী ১০ হাজারেরও অধিক চারা রয়েছে । বর্তমানে বীজ থেকে খেজুরগাছের চারা তৈরী করেছেন জাকির। সেই চারা বিক্রি করছেন আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অনলাইনেও খেজুরগাছ প্রেমীদের চাহিদা মিটাচ্ছেন। গত তিন বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। শুরুর দিকে ২০শতক জমিতে লাগানো ১৯টি খেজুরগাছের মধ্যে এবার ১৪টিতে আশানুরূপ ফল ধরেছে। এসব গাছে প্রায় ২০ মণ খেজুর পাবেন এমনটাই আশা করছেন তিনি। খেজুর গুলো এখনো পরিপক্ক হয়নি। সর্বনিম্ন ৫০০টাকা কেজি দর পেলেও ১০ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করবেন এমনটাই আশা করছেন তিনি। বাগান মালিক জাকির হোসেন বলেন, ২০২২ সালে প্রথম দুইটি গাছে ফল ধরেছিলো। এর পর থেকে ফলন বাড়তে থাকে এর মধ্যে থেকে কিছু এলাকাবাসীকে খেতে দিয়েছি কিছু বীজ করে চারা লাগিয়েছি। খেজুর শুরুতে সবুজ রঙের থাকে। ধীরেধীরে রঙ পরিবর্তন হয়ে প্রথমে হলুদ, তারপর গাঢ় লালচে রঙ ধারণ করবে। আগস্টের শেষ দিকে বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে উঠবে।
খেজুর বাগানে সফলতার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিচারণ করে জাকির বলেন, ১৯৯৫ সালে সফলতার সাথে এসএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর পড়াশোনা এগোয়নি। ১৯৯৯ সালে এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে কুয়েত প্রবাসী হন। মোটর গ্যারেজে চাকুরীর পাশাপাশি সেখানকার খেজুর বাগানের শ্রমিকদের সাথে আলাপ হয় তাঁর। নিজ দেশে খেজুর বাগান করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এরপর ২০১৭ সালের শুরুতে ছুটিতে দেশে আসেন। সাথে নিয়ে আসেন বিভিন্ন জাতের ১২কেজি পাকা খেজুর। পৈতৃক জমিতে সেই খেজুরের বীজ বোপন করেন। দিনকয়েক পরে ফিরে যান কুয়েতে। পরে স্বজনদের কাছে জানতে পারেন বীজ থেকে চারা গজানোর কথা। পরে ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে জাকির সিদ্ধান্ত নেন এবার দেশে গিয়ে কিছু করবেন। আবারও ৫কেজি খেজুর সাথে নিয়ে দেশে আসেন এবং খেজুরবাগান করার কাজে মনোনিবেশ করেন।
জাকিরের বাগানে মরিয়ম, আজওয়া, খলিজি, মেডজল ও আম্বার জাতের খেজুরগাছ রয়েছে। আকৃতির দিক থেকে খেজুরগুলো কোনটি গোলাকৃতির, কোনটি লম্বা। প্রতিদিন তাঁর খেজুর বাগানে দর্শনার্থীরা ভীড় করছেন, কেউকেউ চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিটি দুই বছর বয়সী খেজুরগাছের চারা বিক্রি করছেন ১ হাজার টাকা পিছ হিসেবে। আর প্রতিটি কলম চারার মূল্য রেখেছেন প্রতিটি ১৫-৩০ হাজার টাকা। ছাদে লাগানোর জন্য প্লাস্টিকের ড্রামেও চারা প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ যখন জানলো চাকুরী ও ব্যবসা ছেড়ে দেশে এসে খেজুর বাগান করছি। তখন অনেকে হাসাহাসি করেছে। নানা প্রশ্ন করেছে। ফ্রিতে চারা দিতে চেয়েছি। গুরুত্ব দেয়নি কেউ। এখন তারাই নিজে থেকে টাকা দিয়ে চারা কিনছেন। যারা চারা কিনেছে এরইমধ্যে কয়েকজনের গাছে ফল ধরেছে। তাদেরকেও মুঠোফোনে নানান পরামর্শ দিচ্ছেন জাকির।
খেজুরগাছের যত্ন নেওয়া, বীজ থেকে চারা উৎপাদন, কলম চারা করার পদ্ধতি, ডাল ছাটাই, ফসল সংগ্রহ-সংরক্ষন বিষয়ে জাকির যেন রীতিমত বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা খেজুর মরুর দেশের ফল। বিষয়টি তা নয়। খেজুরগাছ সবধরনের মাটিতেই হয়। খেয়াল রাখতে হবে জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে কিনা। তবে বেলে-দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। তিনি বলেন, বালি-ছাই-গোবর ও কম্পোস্ট সার মিশিয়ে কয়েকদিন রেখে দিয়ে পরে জমিতে দিতে হবে। খেজুর থেকে প্রাপ্ত বীজ ৪০-৪৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে ট্রেতে বীজ বোপন করতে হয়। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। এভাবে ৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজাবে। কিছুদিন পর ওই চারা প্লাষ্টিকের প্যাকেটে তুলে রাখতে হয়। তারপর আবার তা মাটিতে বোপন করতে হয়।
পঞ্চগড় থেকে জাকিরের কাছে খেজুরগাছের চারা কিনতে আসা তাহেরুল ইসলাম বলেন, পরিচিত একজনের কাছে জাকিরের সন্ধান পাই। তারপর মুঠোফোনে যোগাযোগ করি। ইতিমধ্যে জমি প্রস্তুত করেছি, ২০টি চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছি।
শুধু খেজুরগাছই নয় পাশাপাশি ড্রাগন, লেবু, আমসহ অন্যান্য ফলের আবাদ শুরু করেছেন জাকির। তিনি বলেন, এত সুন্দর পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ এই ফল। যা প্রতিদিন বিশেষ করে রমজান মাসে লাখ লাখ টাকার খেজুর আমাদেরকে আমদানি করতে হয়। অথচ আমাদের দেশে খেজুর চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি আগামী দশ বছরের মধ্যে দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে বাড়িতে এই খেজুর গাছের চারা রোপন করতে। রপ্তানী করতে না পারি যেন খেজুর আর আমদানি করতে না হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। ইতিমধ্যে এলাকার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছি, সাড়াও পাচ্ছি বেশ।
উপজেলা (ভারপ্রাপ্ত) কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবীদ শাহানুর রহমান বলেন, আমরা জাকিরের খেজুর বাগান পরিদর্শন করেছি এবং কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক পরামর্শ প্রদান করা হয়। খেজুর চাষে এ অঞ্চলের কৃষিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিনি খুব ভালো একজন কৃষি উদ্বোক্তা। জাকির যেভাবে খেজুর চাষাবাদ করেছেন এভাবে খেজুর চাষাবাদ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। তার বাগানের খেজুর গুলো সুমিষ্ট এবং সুস্বাদু।