বৃহস্পতিবার, ১৫ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কাশ্মিরে হামলা নিয়ে পাকিস্তানে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে

কাশ্মিরে অভিযানে ভারতীয় বাহিনী

দেশ অনলাইন ডেস্ক

দিন কয়েক আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছিলেন যে বিশ্বের কোনো শক্তি কাশ্মিরকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে পারবে না। জেনারেল মুনির কাশ্মিরকে পাকিস্তানের জাগুলার ভেন (যা মস্তিষ্ক, ঘাড়, মুখের একাংশ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিন্ডে পৌঁছে দেয়) বলে অভিহিত করেছিলেন। ভারতকে নিশানায় রেখে কাশ্মিরের বিষয়ে তার মন্তব্য ঘিরে ভারতে বিতর্কও দেখা গিয়েছিল। সাম্প্রতিক ঘটনায় সেই বিতর্ক আবার উস্কে উঠেছে।

এদিকে, পহেলগামে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ নিয়ে যেকোনো সন্দেহ খারিজ করে শোক জানিয়েছে পাকিস্তানও।
ভারত শাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মূলত পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো মঙ্গলবারের এই হামলাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিশ্বনেতারা হামলার নিন্দা করেছেন। বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তানও।

পাকিস্তানের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের অনন্তনাগ জেলায় হামলায় পর্যটকদের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এই হামলার সাথে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো সবই তাদের দেশীয় বিদ্রোহ। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। একটা নয়, দুটো নয়, কয়েক ডজন রাজ্যে- নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মির, দক্ষিণে, ছত্তিশগড়ে, মণিপুরে।

তবে তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান সব সময় যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে, ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাই কমিশনার আব্দুল বাসিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারতের যেকোনো ধরনের দুঃসাহসিক কাজ ব্যর্থ করতে পাকিস্তান সর্বভাবে প্রস্তুত। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এবার পাকিস্তানের তরফে যথাযোগ্য জবাব দেয়া হবে।

পাকিস্তানে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ও সাংসদ শেরি রহমান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, পহেলগামের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করছি। দুর্ভাগ্যবশত, এই হামলার জন্য আগেভাগে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা ভারতের দিক থেকে একটা সাধারণ বিষয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতের সমালোচনাও করেছেন তিনি। তার মতে, ভারত নিজেদের ব্যর্থতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং দায়িত্বশীল সম্পৃক্ততার দাবিতে তোলা বৈধ কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি তাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাও করা হয়। অনুমান করা যেতে পারে যে কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই এখন ভারতের দক্ষিণপন্থী শিবির পাকিস্তানকে ধ্বংসের ডাক দেবে।

উমর আজহার নামে পাকিস্তানের এক নাগরিক এক্স হ্যান্ডেলে জেনারেল মুনিরের দিন কয়েক আগের ওই ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেছেন। ভিডিওতে পাকিস্তান সেনাপ্রধানকে বলতে শোনা গিয়েছিল, কাশ্মিরী ভাইদের পাকিস্তান একলা ছেড়ে দিতে পারে না। তার ভাষণের সেই ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করে উমর আজহার লিখেছেন, পাঁচ দিন আগে জেনারেল মুনির একটা উন্মত্ত ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান কাশ্মিরি ভাইদের একা ছেড়ে দিতে পারে না। এখন দেখা যাচ্ছে যে প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল, এটা তার চাইতেও মন্দ। জেনারেলের এ ধরনের বক্তব্য দেয়া উচিৎ হয়নি।
ওমর আজহারের ওই পোস্ট পুনরায় শেয়ার করে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা লিখেছেন, ভারতের কাশ্মিরে হামলার পর এই উৎসাহ কী মনোভাব নেয় তা দেখার বিষয়।

ভারতেও জেনারেল মুনিরের বক্তব্যের সমালোচনা দেখা গেছে।
ভারতের ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য হিন্দুর কূটনৈতিক সম্পাদক সুহাসিনী হায়দার জেনারেল মুনিরের ভাষণ সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশ করে বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের গত সপ্তাহের বক্তব্য এখন আরো বেশি শিরোনামে চলে এসেছে। শুধু কাশ্মিরে হিংসার হুমকি দেওয়ার কারণে নয়, তার ভাষা সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনমূলক। দুটোই আজকের সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য ও নৃশংসতার সাথে যুক্ত বলে মনে হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিরক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল মুনিরের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানি সেনাপ্রধান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা সময়োপযোগী ছিল না। জেনারেল মুনির বলেছিলেন- আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। কাশ্মির আমাদের জাগুলার ভেন, আমরা এটা ভুলতে পারি না। আমরা আমাদের কাশ্মিরি ভাইদের সংগ্রাম ভুলতে পারি না।

৭ অক্টোবরের প্রসঙ্গ টানলেন হুসেইন হক্কানি
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হক্কানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটা পোস্টে উল্লেখ করেছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর গাজা ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে ডুবে যায়। ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মিরে হামলাও সম্ভাব্য পরিণতির দিক থেকে সমান ভয়ঙ্কর।

পাশাপাশি, তিনি জানিয়েছেন যে রাষ্ট্র ব্যতিরেকে সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এই হামলাকারীদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা করা উচিৎ।
পাকিস্তানের কামার চিইমা আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক। পহেলগামের হামলা নিয়ে তিনি মুসলিম অফ আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ তারারের সাথে কথা বলেছিলেন। সেই সময় সাজিদ তারার জানিয়েছেন, এই হামলার যে টাইমিং, তাতে একাধিক বার্তা রয়েছে।
সাজিদ তারার বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরো খারাপ হবে। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত একটা পরিচিতি পেয়েছে। কাশ্মিরের পরিস্থিতি ভালো হচ্ছিল এবং প্রচুর পর্যটক সেখানে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আরো একবার সেটা লাইনচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
ভারতে এই জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটলেই পাকিস্তানকে নিশানা করা হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন সে দেশের অনেকেই। পাকিস্তানি গণমাধ্যমেও একই কোথা প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানকার নিউজ চ্যানেল সামা টিভির উপস্থাপক পহেলগাম হামলার সম্পর্কে বলেন, ভারতে কোনোরকম সন্ত্রাসী হামলা হলেই সরাসরি পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হয়।

পাকিস্তানি সাংবাদিক সিরিল আলমেইদা এক্স-এ উল্লেখ করেছেন, ভারত যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে যারা এই কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া দরকার… তাহলে কেউ কি তাদের থামাতে পারবে?
এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর প্রতিরক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক যোশী বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি ভারত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। এই প্রসাথে এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টও করেছেন তিনি।

শশাঙ্ক যোশীকে একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অনুমান সত্যি হলে তার সম্ভাব্য তারিখ কবে? জবাবে যোশী লিখেছেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহে হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। আর আমি এটা নিয়ে মজা করছি না।

পাকিস্তানের সেনা প্রধানের বক্তব্য
ইসলামাবাদে এই প্রথমবার বার্ষিক ওভারসিজ পাকিস্তান কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৩ থেকে ১৬ এপ্রিল আয়োজন করা হয়েছিল ওই অনুষ্ঠান। সেখানে ভাষণ দেয়ার সময় কাশ্মিরের প্রসাথে দ্বিজাতি তত্ত্ব টেনে এনেছিলেন জেনারেল মুনির। ভাষণে কাশ্মিরকে পাকিস্তানের জাগুলার ভেন হিসাবে আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যও তুলে ধরেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, কাশ্মিরের বিষয়ে আমাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট এটা আমাদের জাগুলার ভেন ছিল এবং থাকবে। আমরা একে ভুলব না। আমরা আমাদের কাশ্মিরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ত্যাগ করব না।
উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়ে অবগত করতে হবে। তিনি বলেছিলেন, আপনাদের সন্তানদের পাকিস্তানের কথা বলতে হবে। যাতে তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের চিন্তা-ভাবনাকে ভুলে না যায়- যে আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা।

আমাদের ধর্ম, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-ভাবনা, উদ্দেশ্য সবই আলাদা।
জেনারেল মুনিরের বক্তব্যে বিভাজনমূলক বিষয় রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে এবং একে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার ভাষণের পরপরই পাকিস্তানের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, তার বক্তব্যের জেরে পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা বাড়তে পারে। হিন্দুরা পাকিস্তানের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

পাকিস্তানের সুফি পণ্ডিত ও সাংবাদিক সাবাহাত জাকারিয়া জেনারেল মুনিরের ভিডিও ক্লিপের বিষয়ে বলেন, প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কারা? আমরা যদি হিন্দু ও মুসলমানদের কথা বলি, তাহলে ভারতে ২০ কোটি মুসলমান বাস করে। আপনি যদি আপনার চিন্তাধারা অনুযায়ী চলেন, তাহলে এই ২০ কোটি মুসলমানও বাকি ভারতীয়দের থেকে আলাদা।

Share This