শুক্রবার, ১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সফল কৃষি উদ্যোক্তা লাজু নিজে স্বাবলম্বি হয়ে অন্যদের উৎসাহিত করছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক
তৈয়বুর রহমান লাজু (৪৮)। ছোটবেলা থেকেই গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে উঠা তাই কৃষির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ তাঁর। চাকুরির পিছনে না ছুটে নিজ জমিতে নানা ধরনের শাকসবজিসহ সাথী ফসল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন তরুন এই সফল কৃষি উদ্যোক্তা। কৃষিতে মনোনিবেশ করে তিন বছরে বদলে গেছে লাজুর জীবনের মোড়। নিজেকে এলাকার একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার দেখাদেখি শুধু পুরুষরাই নয় ওই এলাকার নারীরাও বেশ উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন।
লাজুর বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। তাঁর বাবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা আকবর আলী। বাবার অবসরে পর তিনিই সংসারের হাল ধরেন। নিজ এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। বিবাহিত জীবনে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সংসার সামলাতে গিয়ে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশুনার পর কিছুদিন বন্ধ ছিল। বর্তমানে ব্যাবসার পাশাপাশি পৈত্রিক জমিতে ছাষাবাদ শুরু করেছেন। এর ফাঁকে আবারও পড়াশুনা শুরু করেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হবে। কৃষি থেকে বর্তমানে তার বাৎসরিক আয় আসছে ৮-১০ লাখ টাকা।
লাজু বসতবাড়ির কাছে নিজ জমিতে কচুর লতি চাষ শুরু করেছেন। আগে ওই জমিতে অন্যন্য রবি শস্য চাষাবাদ করে তেমন লাভ হত না। বীজ রোপন থেকে পরিচর্যার সব কৌশল শিখেছেন কৃষি অফিসসহ ইউটিউব থেকে। তার জমিতে দুই জন লোক দৈনিক হাজিরার মাধ্যমে কাজ করে। তিনি একাই জমির দেখভাল করেন। ভালো ফলনের জন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারও ব্যবহার করেছেন।
লাজু বলেন, কৃষি নিয়ে আমি তিন বছর ধরে স্টাডি করছি। আমাদের এলাকায় কেউ লতি চাষ করে না। ইউটিউব দেখে জানতে পারি কচুর লতি একটি লাভজনক ফসল, এতে স্বল্প খরচে অধিক লাভ হয়। অন্যান্য কৃষিপণ্যর চেয়ে লতি চাষ করা সহজ এবং রোগ বালাইয়ের ঝামেলা নেই। তাই সিদ্ধান্ত নেই আমিও লতি চাষ করব। প্রথমবার পরিক্ষামুলকভাবে নিজের ৩০ শতাংশ জমিতে লতি চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ হাজার টাকার লতি বিক্রি করেছি। আরও ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার লতি বিক্রি হবে। এছাড়া লতি উৎপাদন শেষে অবশিষ্ট কুচু গাছগুলো বিক্রি হবে এবং জমি থেকে ওই গাছগুলো তোলার পর যে চারা গজাবে, সেই চারাও বিক্রি হবে।
এই চাষি আরও জানান, কচুর লতি চাষ করলে বছরের ৭-৮মাস মাস তোলা যায়। জমিতে বীজ ফেলার দুই মাসের মাথায় লতি তুলে বাজারে বিক্রি শুরু করা যায়। সপ্তাহে দুইদিন লতি তুলতে হয়। প্রতি সপ্তাহে ৬-৭মন কচুর লতি উঠে জমি থেকে। সেগুলো পানিতে ধুয়ে ওজন করে আটি বেঁেধ বাজারে নিয়ে যাই। প্রতি মন কচু পাইকাড়ী বিক্রি হয় ১২-১৫শ টাকায়।
লাজু বলেন, তার এই কাজে সহযোগিতা করেনে তার স্ত্রী তৌহিদা বেগম, ছেলে তৌফিক এলাহী। উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর থেকে পরামর্শসহ বিভিন্নভাবে তাকে সহযোগিতা করেন। তিনি পবর্তিতে আরও এক একর জমিতে কচুর লতি চাষ করতে চান।


তিনি বলেন, প্রথমে যখন লতি চাষ শুরু করি, এলাকার আনেক কৃষক আমাকে বলেছিল এই ফসল আমাদের এলাকায় তেমন কেউ করে না। এতে অনেক ধামেলা এসব করে কি হবে। এ নিয়ে আনেকেই নিরুৎসাহিত করে। তবুও থেমে থাকিনি, আমার তিব্র ইচ্ছে লতি চাষ করবই। এখন আমার দেখাদেখি আনেকেই উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা গ্রামের কৃষকরা যাতে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মুল্য পাই, সে বিষয়ে আমার একটা বিষয় চিন্তা করেছি। এলাকার কৃষকরা একই সাথে একি পণ্য ছাষাবাদ করতে হবে। সকল পণ্য একত্রিত করে গাড়ীতে করে যদি রাজধানী ঢাকায় পাঠাতে পারি তাহলে কৃষকরা সরাসরি ন্যায্য মুল্য পাবে। এতে আমরা সবাই সাবলম্বি হয়ে উঠবো।
লাজু বলেন, আমরা যারা পড়াশুনা শেষ করে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি খুজছি। চাকরির পিছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে ভালো কিছু করতে পারি। এতে একদিকে পরনির্ভর হতে হবেনা, অন্যদিকে স্বাধীন ভাবে জীবনযাপন করে স্বাবলম্বি হব।
শুধু লতি নয় এর পাশাপাশি তিনি একই জমিতে সাথী ফসল হিসেবে ৭৭শতক জমিতে ২৩০টি গৌরমতি আম গাছের মাঝে মাঝে ৬০০ পেয়ারা গাছ লাগিয়েছেন তরুণ কৃষি উদ্বোক্তা তৈয়বুর রহমান লাজু । গাছ গুলোতে থোকায় থোকায় আম এবং পেয়ারা এসেছে। এর মধ্যে কিছু বিদেশি উন্নত জাতের আমও রয়েছে। আরেকটি ৭৫শতক জমিতে আম গাছের মাঝে মাঝে বস্থায় আদা চাষ করেছেন। সেখানে ৩৬০টি বারি-৪ আম গাছ এবং ১হাজার ২শ বস্তায় আদা চাষ করেছেন। চলতি মৌসুমে ওই বাগান থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার আম বিক্রির আশা করছেন। অন্য একটি ২০ শতক জমিতে ৪৬ টি (নেওয়া) শরিফা গাছ লাগিয়েছেন, সেখানে সাথী ফসল হিসেবে ১৬১টি পেপে গাছ লাগিয়েছেন, সেগুলোতে ফল এসেছে। এতে করে একই জমি ব্যবহার করে দুইটি ফসল ফলানো যাচ্ছে। তাতে সময় এবং জমি দুটোই কাজে লাগছে। সেইসাথে ২০০টি বরই গাছের একটি বাগান ও কলা বাগান লাগিয়েছেন। একইসাথে একটি গরুর খামার করেছেন, সেখানে ৬টি গরু রয়েছে। যার গোবর থেকে ভার্মিকম্পোষ্ট সারের জন্য হাউজ তৈরী করেছেন। তার এই চাষাবাদ দেখে শুধু পুরুষরাই নয় এলাকার নারীরাও বেশ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। এদিকে বাগান দেখাশুনার জন্য তিনি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন।
লাজুর দেখাদেখি দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য নুরবানু তার বাড়ীর পাশে ২০শতক জমিতে মালটা, আম বাগানসহ পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তুলেছেন। বাগানে গাছের মাঝে মাঝে ২শ বস্তা আদা চাষ করেছেন।
সাবেক ইউপি সদস্য নুরবানু বলেন, লাজু ভাই আমার প্রতিবেশি তার দেখাদেখি আমিসহ অনেকেই কৃষিতে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করছি। তার পরামর্শে কৃষি অফিস থেকে প্রষিক্ষণ নিয়েছি। বাগান করেছি এবং ভার্মিকম্পোষ্ট সারের জন্য হাউজ তৈরীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। একই কথা বলেন ওই এলাকার কৃষক আবুল কালাম ।
এলাকার তরুন কৃষকদের নিয়ে সোসাল মিডিয়া ফেইসবুকে একটি গ্রুপ তৈরী করেছেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। সেখানে তারা বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করে থাকেন। এদিকে কৃষিকাজের পাশাপাশি তিনি ডিজিট্যাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবেও কাজ করে সফলতা পেয়েছেন। জমিতে ফসল ফলানোসহ সকল কাজের ভিডিও ধারণ করে তা নিজের ফেইসবুক প্রফাইলে আপলোড করে সেখান থেকেও আয় করতে শুরু করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শাহানুর রহমান বলেন, ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে তৈয়বুর রহমান লাজু একজন ভালো কৃষি উদ্বোক্তা। ইতিপুর্বে কৃষি কর্মকর্তাসহ তার প্রজেক্ট গুলো পরিদর্শন করেছি। তিনি বলেন, সাথী ফসল এবং যৌথ বাগান একটি লাভজন ফসল। এটি করলে ভুমির সর্বউত্তম ব্যবহার হয় এবং উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে এটি অত্যন্ত লাভজনক কৃষকের জন্য। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ আমরা তাকে সবরকম পরামর্শসহ কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকি।

Share This